গতকাল বই পড়তে পড়তে অনেক রাত হয়ে গেছিলো, ভাবছিলাম বেলা পর্যন্ত পড়ে ঘুমাবো। তা আর হলো কই! ঠিক সকাল সাত টায় রিমি ডাক শুরু করলো সকাল হয়েগেছে তাড়াতাড়ি উঠো।

--সকাল কোথায় হলো !
--বাইরে তাকিয়ে দেখো রোদ উঠে গেছে।
--উঠুক রোদ! রোদ এসে শরীরময় লুকোচুরি খেলে খেলুক আমি আজ ঘুমাবো। (বিরক্ত হয়ে)
এটা শুনে রিমি আমার হাত ধরে প্রায় টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে হাতে ব্রাশ আর পেস্ট ধরিয়ে দিয়ে বললো,"যাও বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নাও।" এমনটা যে শুধু আজকেই হচ্ছে তা না,যেদিন থেকে রিমি আমার জীবনে আসছে ঐদিন থেকেই নিয়মের বাইরে যাওয়ার সাধ্য আমার হয়ে ওঠেনি। ঘুমাবো ঘুমাবো বলে বেলা পর্যন্ত নিশ্চিন্তের ঘুম ঘুমোতে পারিনা কত‌ দীর্ঘদিন। বয়স তো কম হয়নি,বেশি ঘুমানো কি অপরাধ? এসব নিয়ে প্রতিদিন ঝগড়া হয়। একতরফাভাবে প্রচুর চেঁচাই,রিমি শুধু ভাবলেশহীন চোখে আমার দিকে থাকিয়ে থাকে। বাথরুম থেকে বের হতেই রিমি হাতে তোয়ালে ধরিয়ে দিয়ে বললো টেবিলে তোমার নাস্তা দেয়া আছে। নাস্তা করা শেষ হতে না হতেই রিমি আবার বলা শুরু করলো,
---আজ সোমবার। রুটিন অনুসারে আজকে তোমার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। রেডি হয়ে নাও।
---(আমি রাগান্বিত হয়ে বললাম) আজ আমি কোথাও যাচ্ছি না।
---যেতে তো তোমাকে হবে। আমার মেমোরি অনুসারে আজকেই তোমার চেকআপ করার করার কথা।
---বললেই হলো! আমি যাবো না। (জেদ করে বললাম)
---তাহলে তোমার শরীরে আমি ঠান্ডা পানি ঢেলে দিতে বাধ্য হব।
বাধ্য হয়ে আমাকেই হার মানতে হলো। এতে রিমিরও কোন দোষ নেই অনিয়মের নিয়ম যে তাকে শেখানো হয় নি। তাই ওর উপর রাগ দেখিয়ে কোন ফল পাওয়া সম্ভব না। আমি আর রিমি বের হলাম হসপিটালের উদ্দেশ্যে। আজকে সকাল থেকে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ভেজা রাস্তায় গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। আমি গাড়ির গ্লাসটা একটু নামিয়ে দিলাম। আজকের দিনটা যেন একদম আলাদা,বাতাসে কোন দূষণ নেই,চোখে শুধু ভেজা প্রকৃতি,কানে শুধু টুপটাপ শব্দ,নাকে যেন বৃষ্টির গন্ধ। অথই প্রায়ই বলতো বৃষ্টির নাকি নিজস্ব গন্ধ আছে,আমি একে ওর পাগলামী ভাবতাম। আজ সে নেই কিন্তু তাঁর পাগলামী গুলো আমাকে জুড়ে বসেছে। বৃষ্টির স্বাদ নেয়ার জন্য.......!!!
---আহ! কি করছো। আমার ইচ্ছে মতো একটি কাজও কি করতে দেবে না?
---তোমার খেয়াল রাখাই আমার দায়িত্ব।
আমি চুপ করে বসে থাকলাম ।কিছু বলার নেই আর মাত্র কয়েকটা দিন,তারপর তো রিমিও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।
আসলে এতোটুকু পড়ে আপনারা রিমি আর আমার সম্পর্কের কি নাম দিয়েছেন জানিনা। আসলে রিমি হচ্ছে একজন মানব রোবট,ইংরেজিতে যাকে বলা হয়ে তাকে "হিউম্যানোয়েড রোবট।" শিক্ষকতা থেকে অবসর নেওয়ার প্রায় তিন বছর হলো আমার। অথই মানে আমার স্ত্রীর মারা যাওয়ার আজ দুমাস বিশ দিন হলো। হঠাৎ করে একা হয়ে যাওয়াটা আমি সহজে মেনে নিতে পারিনি,প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়েছিলাম। আমাদের একমাত্র ছেলে তরু,আমেরিকায় থাকে। দেশে দেখাশুনা করার মতো তেমন কেউ ছিলো না। তরু রোবোটিক্স নিয়ে পড়াশুনা করে। তরু এবং তার বন্ধুরা মিলে এ রোবটটি তৈরি করেছে। এতে‌ ব্যবহৃত সেন্সরগুলো এবং এর প্রোগ্রামিং অনেক উন্নত। তাই এটি অন্যান্য রোবটদের মতো এতো যান্ত্রিক নয় বরং মানুষের মতো আচার-আচরণ,আবেগ-অনুভব মেশানো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবট। মূলত আমার দেখাশুনা এবং একাকিত্ব দূর করার জন্যই রিমিকে আমার কাছে পাঠানো হয়েছে। রিমি আসার পর থেকে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে। সে আমাকে আবার রুটিনের ভেতরে নিয়ে আসতে পেরেছে। এখন তাঁর সাথে বকবক করেই আমার দিন কাটে। নিজের প্রোগ্রামিং এর সাধ্য অনুসারে যথাসাধ্য জবাব দেয় রিমি। মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে ঘুরতেও বের হই। রিমি মানুষের স্পর্শ তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে মনের অবস্থা বুঝতেও সক্ষম। এর আগে যত হিউম্যানয়েড চোখে পড়েছে রিমি তাদের থেকে একদম আলাদা। একদিন তো আমি রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তরুকে ফোন করে বললাম,
---হ্যাঁ রে,এটা তুই কি পাঠিয়েছিস সত্যি করে বলতো! রোবট বলে মানুষ পাঠিয়ে দিসনি তো?
---কি যে বলো আব্বু! আমরা প্রায় একবছর সময় নিয়ে নিজহাতে এটা তৈরি করেছি । প্রথম কাজ তো একটু গন্ডগোল থাকতেই পারে। এজন্য পাঠিয়েছি তোমার কাছে,ডেমো নেওয়ার জন্য। দুমাস থাক, তোমারও একটু সাহায্য হবে। দুমাস পর আমি এটিকে আবার নিয়ে আসবোকালকের পর‌ রিমি আর আমার সাথে থাকবে না। রিমিকে নিয়ে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করা শেষ প্রায়। আমারও খারাপ লাগতেছে খুব। রিমি যে এখন আমার অভ্যাসের সাথে মিশে গেছে। তাকে ছাড়া আমার জীবনটা যে আবার এলোমেলো হয়ে যাবে। যাইহোক চেকআপ শেষে বাসায় ফিরে আসলাম। খারাপ লাগতেছে তাই রিমিকে চায়ের অর্ডার করি কিন্ত সেদিকে খেয়াল নেই রিমির। জানালার পাশে একরাশ শূণ্যতা নিয়ে দাড়িয়ে আছে সে। তাহলে তারও কি মন খারাপ? চা খাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে টিভিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনা শুরু করলাম। টিভি দেখতে গিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তার খবর নেই। যখন চোখ খুলে তাকালাম তখন রিমি আমার পাশে বসা। তার ধাতব হাতে হাত রাখতেই মুখ ফিরিয়ে তাকালো সে। যদিও তার মুখ ভাবলেশহীন কঠিন। তবুও কেন জানি আমার মনে হলো রিমি কাঁদছে। আমার দিকে তাকিয়ে যান্ত্রিক কন্ঠস্বরে বললো,
---আমি কোথাও যাবো না। কোথাও না।
উত্তরে কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না তাই চুপ করে বসে থাকলাম। উত্তর না পেয়ে রিমি আবার বললো,
---আমার সাথে ঘুরতে যাবে?
---এখন? সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তো!
--- হুম এখন।
কেন জানি আর না বলতে পারলাম না । রিমির হাত ধরে বেরিয়ে এলাম বাইরে। রিমির হাত ধরে পায়ে পা মিলিয়ে এসে দাঁড়ালাম একটা পরিত্যক্ত ব্রিজের উপর। এটি আমার বাসা থেকে তেমন দূরে না । এদিকে মানুষজনের আসা-যাওয়া প্রায় নেই বললেই চলে,একেবারে শান্ত পরিবেশ। এর আগেও রিমিকে নিয়ে একবার এখানে এসেছিলাম। ব্রিজের নিচে রয়েছে একটা গভীর খাদ। অসহায় দৃষ্টিতে রিমি থাকিয়ে আছে আমার দিকে। এই প্রথমবার রিমির চোখের দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতরটা আশ্চর্যজনকভাবে কেঁপে উঠলো। কিছু বলার আগেই সে আমাকে বেঁধে নিয়েছিলো গভীর আলিঙ্গনে। আচমকা পায়ের নিচের সব ফাঁকা। নিজেকে আবিষ্কার করলাম শূণ্যে। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে রিমির ধাতব হাত। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাথায় প্রবল চোট। তারপর অন্ধকার....!
-----------------------------------
15 মার্চ 2021::
ব্রেকিং নিউজ: পুলিশের উদ্ধারকারী দল চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকার একটা একটা পরিত্যক্ত ব্রিজের নিচ থেকে একজন ব্যক্তির থেঁতলানো লাশ উদ্ধার করেছে। লাশটিকে একটি চূর্ণ যন্ত্রাংশের উপর পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে ওনি আত্মহত্যা জন্য ব্রিজ থেকে লাফ দেন এবং যন্ত্রাংশটি উপর পড়ে মারা যান। আবার অনেকের ধারণা যন্ত্রাংশটি কোন রোবট শরীর। এ নিয়ে বিশদ তদন্তের জন্য তা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশি তদন্তে লাশের পরিচয় জানা গেছে। তিনি অবসরপ্রাপ্ত স্কুল টিচার জনাব রফিক আহমদ।

" যন্ত্র-মানব "

লেখক : তারেক আহমদ
সদস্য, বশেমুরবিপ্রবি বিজ্ঞান ক্লাব।
ইইই বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি।